তাফসির জগতের তারকা বক্তারা: প্রভাব, দায়িত্ব ও বাস্তবতার বিশ্লেষণ – দৈনিক নতুন কলম

তাফসির জগতের তারকা বক্তারা: প্রভাব, দায়িত্ব ও বাস্তবতার বিশ্লেষণ

লেখক: প্রতিবেদক ঢাকা
প্রকাশ: October 9, 2025

তাফসির জগতের তারকা বক্তারা: প্রভাব, দায়িত্ব ও বাস্তবতার বিশ্লেষণ

লেখকঃ মোহাম্মদ মাহববুল আলম ফারুকী

সহকারী সেক্রেটারি।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী যুব বিভাগ।
২নং শৌলমারী ইউনিয়ন শাখা।

রৌমারী কুড়িগ্রাম।

বাংলাদেশের ইসলামি অঙ্গনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাফসিরভিত্তিক বক্তাদের উত্থান এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেছে। তরুণ প্রজন্মের কাছে তারা জনপ্রিয়তার শীর্ষে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের প্রভাব বিস্তৃত ও গভীর। নিঃসন্দেহে তারা দেশের তাফসির জগতের ‘স্টার আইকন’। কেউ কেউ তাদের মধ্যে একজনকে শহিদ আল্লামা সাঈদীর উত্তরসূরী হিসেবে দেখেন, আরেকজনকে স্বৈরাচারের রোষানলে নিপীড়িত এক মাজলুম আলেম হিসেবে বিবেচনা করেন।

তাদের তাফসির মাহফিলে মানুষের ঢল নামে— মসজিদ, মাঠ, এমনকি অনলাইনেও লাখো মানুষ তাদের ব্যাখ্যা শোনেন। ইসলামী দাওয়াত ও তাফসিরের ক্ষেত্রে তারা নিঃসন্দেহে এক নতুন ইতিহাস তৈরি করেছেন।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে— এই জনপ্রিয়তার সঙ্গে যে দায়িত্ববোধের ভার আসা উচিত, তা কি যথাযথভাবে বহন করা হচ্ছে?

জনপ্রিয়তা আশীর্বাদ, কিন্তু একই সঙ্গে পরীক্ষা

জনপ্রিয়তা যেমন আল্লাহর এক নিয়ামত, তেমনি তা বড় একটি পরীক্ষা। একজন ইসলামি বক্তার মুখে উচ্চারিত প্রতিটি বাক্য সাধারণ মানুষ ইসলামের ব্যাখ্যা হিসেবেই গ্রহণ করে। সুতরাং তাঁর কোনো অপ্রাসঙ্গিক বা উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য শুধু ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিকেই নয়, বরং সংগঠন, দাওয়াতি কাঠামো ও বৃহত্তর ইসলামি আন্দোলনকেও বিব্রত অবস্থায় ফেলে দেয়।

সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বক্তার অযাচিত শব্দচয়ন বা আবেগপ্রবণ মন্তব্য সমাজে অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আর মাঠপর্যায়ের কর্মীরা জনমানুষের প্রশ্নের মুখে পড়ছেন।

আমরা যারা পাড়া-মহল্লা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে দাওয়াতি কাজ করি, তাদের প্রায়ই বিব্রতকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। কেউ বলেন, “আপনাদের বড় আলেম তো অমুক কথা বলেছেন!” আবার কেউ বিদ্রুপ করে বলেন, “এরা ইসলাম শেখায় না, রাজনীতি করে।” এমন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ছোট পর্যায়ের কর্মীরা সংকটে পড়ে যান।

যেখানে আমাদের মতো কর্মীরা সপ্তাহজুড়ে পরিশ্রম করেও ৫০ জন মানুষকে সমাবেশে আনতে হিমশিম খান, সেখানে এই তারকা বক্তাদের নাম শুনলেই হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়। তাই তাদের প্রতিটি বক্তব্যের প্রভাব বিশাল— আর সেই প্রভাব যত বড়, দায়িত্বও তত বেশি। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ব্যাখ্যা হিকমত ও সংযমের সঙ্গে বলা তাদের জন্য অপরিহার্য।

বর্তমান যুগে তাফসির মাহফিল শুধু ধর্মীয় অনুষ্টান নয়; এটি এখন এক বিশাল মিডিয়া ইভেন্ট। ইউটিউব, ফেসবুক, টিকটকসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে তাদের বক্তব্য মুহূর্তেই ভাইরাল হয়। কিন্তু এই ভাইরাল সংস্কৃতি একটি নতুন চ্যালেঞ্জও তৈরি করেছে— বক্তব্যের বিকৃতি, প্রসঙ্গহীন উদ্ধৃতি, ও ভুল ব্যাখ্যার প্রসার।

একজন বক্তার বক্তব্য যত বেশি ছড়ায়, তার দায়িত্বও তত বেশি বেড়ে যায়। কারণ একটি ভুল ব্যাখ্যা, একটি অতিরঞ্জিত মন্তব্য, কিংবা একটি রাজনৈতিক ইঙ্গিত হাজারো মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে।

তাফসির বক্তারা নিঃসন্দেহে এই সময়ের প্রভাবশালী দাঈ। তাদের মাধ্যমে মানুষ কোরআনের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে, দাওয়াতি চেতনা জাগ্রত হচ্ছে— এটি নিঃসন্দেহে বড় এক নিয়ামত। কিন্তু এই নিয়ামতের সঠিক ব্যবহারই প্রকৃত কৃতজ্ঞতার প্রকাশ।

তাদের উচিত— বক্তব্যে সংযম ও প্রজ্ঞা বজায় রাখা, অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক এড়িয়ে চলা, এবং সংগঠন ও ইসলামের মর্যাদা রক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া।

কারণ একজন আলেমের কথা কেবল তাঁর নয়— সেটি তাঁর সংগঠন, আদর্শ ও অনুসারীদের ভাবমূর্তির প্রতিফলন। দায়িত্বহীন একটি শব্দ কখনো কখনো পুরো দাওয়াতি পরিসরকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে পারে।

শেষ পর্যন্ত মনে রাখতে হবে— শব্দেরও ওজন আছে, আর আলেমের জিহ্বা কোরআনের দাওয়াতের প্রতিনিধি। সে জিহ্বা যদি সংযম হারায়, তাহলে বার্তাটিও তার মর্যাদা হারায়।