
শিক্ষক যেন দাবার গুটি
— এক অনন্ত বঞ্চনার ইতিহাস
মোঃ মাহবুবুল আলম ফারুকী
সহকারী শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা) ও সাংবাদিক
কাজাইকাটা উচ্চ বিদ্যালয়।
শিক্ষক— শব্দটি মানেই আলোর পথপ্রদর্শক, সমাজের বিবেক। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, যুগে যুগে বাংলাদেশের শিক্ষকদেরকে ব্যবহার করা হয়েছে রাজনীতির দাবার গুটি হিসেবে। ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে কখনও তাদের ব্যবহার করা হয়েছে জনমত গঠনে, কখনও রাজনৈতিক আন্দোলনের মুখে বলি হিসেবে। সরকার বদলেছে, কিন্তু শিক্ষকদের অবস্থান বদলায়নি।
🔹 ইতিহাসের ধারাবাহিক বঞ্চনা
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই শিক্ষক সমাজ বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন।
১৯৭৪ সালে সরকার যখন শিক্ষানীতির সংস্কারের নামে শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ায়, তখন থেকেই শুরু হয় বঞ্চনার ধারা।
১৯৯০-এর দশকে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকরা বারবার আন্দোলনে নামেন— বেতন বৈষম্য, জাতীয়করণ, ও এমপিওভুক্তির দাবিতে।
২০০৫ সালে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ২১ দিন টানা কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছিলেন। কিন্তু প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন, বাস্তবায়ন পাননি।
২০১৮ সালে ঘোষিত “শিক্ষা সেবা জাতীয়করণ নীতি” শিক্ষক সমাজে নতুন আশা জাগালেও পরে সেটি রাজনৈতিক কারণে থেমে যায়। ২০২4 সালেও শিক্ষকরা আবার রাস্তায়— একই দাবি, একই ব্যথা, শুধু সরকার বদলেছে, দাবিগুলো বদলায়নি।
🔹 শিক্ষকদের রাজনীতিকরণ: এক বিপজ্জনক প্রবণতা
বাংলাদেশে শিক্ষা প্রশাসন থেকে শুরু করে শিক্ষক সংগঠন পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রভাব প্রবল। ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের প্রভাবে শিক্ষক নেতারা প্রায়শই সরকারি নীতির সমর্থনে অবস্থান নেন, এমনকি ন্যায্য দাবি থেকেও সরে আসেন।
এভাবে শিক্ষকদের সংগঠনগুলো ধীরে ধীরে তাদের মৌলিক উদ্দেশ্য— শিক্ষা ও শিক্ষকদের অধিকার রক্ষা— থেকে সরে গিয়ে রাজনৈতিক বলয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
একজন শিক্ষককে যখন রাজনৈতিক আনুগত্যের মাধ্যমে পদোন্নতি, পদায়ন বা এমপিওভুক্তি পেতে হয়, তখন তা শিক্ষা ব্যবস্থার সততা ও পেশাগত মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
🔹 শিক্ষকদের বেতন-বৈষম্য ও অবমূল্যায়ন
বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বেতন-বৈষম্য মারাত্মক পর্যায়ে। সরকারি কলেজ শিক্ষকরা যেখানে ৮ম থেকে ৯ম গ্রেডে বেতন পান, সেখানে বেসরকারি কলেজ শিক্ষকরা একই যোগ্যতায় ১১তম বা ১২তম গ্রেডে রয়েছেন।
এছাড়া অবসরভাতা, চিকিৎসা সুবিধা, চাকরি স্থায়িত্ব— সবদিক থেকেই বেসরকারি শিক্ষকরা বঞ্চিত।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে (২০২3) উল্লেখ আছে— বাংলাদেশের একজন শিক্ষক গড়ে যতো পরিশ্রম করেন, তার বিনিময়ে আয় পান দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের চেয়েও কম।
🔹 শিক্ষকদের আন্দোলন কেন অব্যাহত?
কারণ সহজ— প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, বাস্তবায়ন হয় না।
দশকের পর দশক ধরে আন্দোলনের মঞ্চে একই দাবিগুলো পুনরাবৃত্তি হচ্ছে—
শিক্ষকদের জাতীয়করণ
বেতন বৈষম্য দূরীকরণ
শিক্ষা প্রশাসনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ
প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত পেশাগত মর্যাদা নিশ্চিত করা
🔹 উপসংহার
যে রাষ্ট্র শিক্ষককে মূল্য দিতে জানে না, সেই রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। শিক্ষককে যদি রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তবে শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত মান কখনো উন্নত হবে না।
আজ সময় এসেছে— শিক্ষকদেরকে তাদের ন্যায্য মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার, তাদের কণ্ঠকে রাজনীতিমুক্ত করে প্রকৃত জাতি গঠনের অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার।
কারণ,
> “শিক্ষক শুধু পেশাজীবী নন, তিনি জাতির আত্মা।”
আর জাতির আত্মাকে দাবার বোর্ডে ফেলে রেখে কোনো জাতি এগোতে পারে না।