রিক্সা চালক রহিম মিয়াঃ
-মাহবুবুল আলম ফারুকী
বাবা আমার ঔষুধটা আনতে ভুলিস না কিন্তু।কাঁশিটা বড় বেড়ে গেছে বাবা।জসিম সাহেব আরকিছু বলতে পারেনি।খক খক শব্দে কাঁশতে শুরু করলেন।রহিম মিয়া নিঃশব্দে সাইকেলটা বের করে যাত্রা শুরু করলো প্রতিদিনকার মতো।ভাগ্যিস তিন বছরের ছেলেটা খেলতে গেছে নাহলে আজো বায়না ধরতো কমলার জন্য।এটা প্রতিদিনকার রুটিন।বাবার ঔষুধ আর ছেলের কমলা কোনোটাই সচরাচর আনা হয়না। বলা হয়ে থাকে মনে নেই।সবটাই মিথ্যা কথা।রহিম মিয়া গেট পার হয়ে রাস্তায় আসে। ভাবে আর কতদিন মিথ্যা বলবো।আজ যেভাবেই হোক বাবার ঔষুধটা আনতেই হবে।সাইকেলে পা রাখতেই ছেলে এসে হাজির আব্বু আইজকা কম্বা আনতেই হইবো।
-আচ্ছা আব্বু আনবো।
বলে রহিম মিয়া দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে চায়।কিন্তু বিধিবাম।সাইকেলে হাওয়া নেই।সম্ভবত লিক হয়েছে।কিছুদুর হেটে গিয়ে সবুর মেকারের দোকানে গিয়ে বললো দেখেনতো ভাই মনে হয় লিক হয়েছে।
সবুর মেকার আড় চোখে দেখে বললো আরে মিয়া টাকা আছে লিক সারবেন?বাকি হবে না কিন্তু।
-ভাই। স্কুল থেকে ফেরার পথেই টাকা দিয়ে যাব।
-একটু ভেংচি কেটে বললো আরে আরে ভাই কপাল খুইলা গেছে নাকি?সরকার বেতন ছারলো নাকি?বলে সাইকেলের লিক সারতে শুরু করলো।রহমান সাহেব সদর হাই স্কুলের ক্লার্ক।স্কুলে যাচ্ছিলো। রহিম মিয়াকে দেখে মটর সাইকেল থামিয়ে বললো দোস্ত সাইকেল নস্ট নাকিরে।আরকত? একটা মটর সাইকেল কিনে ফেল।
রহিম মিয়া বললো আরে ভাই বাবার ঔষুধ কিনতে টাকা পাইনা আবার মটর সাইকেল।
-কি কস তোদের টাকা নেই?
-ও হ্যাঁ দোস্ত একটা উপকার করবি আমার?
-কি উপকার দোস্ত।তোর জন্য জীবন দিতে রাজি।
-নারে দোস্ত এমন কিছু না। ২০০টাকা দিতে পারবি?বাবার ঔষুধ নিতাম।
-দোস্ত আমার একটু তারা আছেরে যাই আবার কথা হবে।
সাইকেল ঠিকরা শেষ।সবুর মেকার বললো নেন ভাই টাকাটা দিয়েন ভাই। বেতনের আশায় রেখে দিয়েন না আবার। রহিম মিয়া স্কুলে যায়।ক্লাস নেয়। মনোযোগ নেই তাতে।আজওকি বাবার ঔষুধ নিতে পারবো না?ক্লাস শেষে কয়েকজন সহকর্মীর কাছে হাত পাতলো রহিম মিয়া।তারাই বা পাবে কোথায়।সবাইতো একই নৌকার মাঝি।অবশেষে ফার্মেসীতে ঔষুধ চাইতেই দোকানদার বললো রহিম ভাই টাকা আনছেন?রহিম কিছু না বলে বেড়িয়ে এলেন সেখান থেকে।গেলেন অন্য ফার্মেসীতে।সেখানেও একই অবস্থা।উপায়ন্তর না দেখে মোবাইলটা বিক্রি করে দিলো রহিম মিয়া।বাবার ঔষুধ ও বাবুর কমলা কিনে বাড়ির দিকে রওনা হলো রহিম মিয়া।বাবা এখনো কাঁশছে।ছেলেটা কমলার জন্য কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে গেছে।রহিম মিয়ার স্ত্রী বেশ চড়া গলায়ই বললো তা তোমার মোবাইল অফ কেনো। রহিম কোনো কথা বলে না।
-কি হলো কিছু বলছো না কেনো?
-মোবাইল নাই।
-নাই মানে?
-নাই মানে নাই।বেচে দিয়েছি।
পাশের রুম থেকে বাবা কাশতে কাশতে বললো বাবা শেষ পর্যন্ত মোবাইলটাও বেচে দিলি?
আর কত বাবা ১৬বছর হলো। চাকরির বয়স গেল। ঘড়ি গেলো, আলমারী গেলো,খাট গেলো,মোবাইল গেলো কিন্তু বাবা তোর বেতন হবে কবে?বাবা লাগবে না তোর এই অভিশপ্ত চাকরী! ছেরে দে!
রহিম নিরবে কাঁদে। অনেক আশা নিয়ে এই স্কুলে যোগ দিয়েছিলো।বাবার একমাত্র সন্তান হয়ে বাবার জমি বিক্রি করে টাকা দিয়েছিলো এখানে।১৬বছর অতিবাহিত হলো কিন্তু বেতন হলো না। বাজারের দোকানদারদের কাছে আতংক রহিম মিয়া।কখন না জানি আবার বাকি চেয়ে বসে।কেটে যায় বেশ কিছুদিন। মোবাইল বিক্রি করা টাকা শেষ।স্কুলে যাওয়ার জন্য বের হয়েছে।বাবার ডাক খোকা আমার ঔষুধ শেষ।রহিম চিন্তা করে আজ কি বিক্রি করবে?
রহিমের স্ত্রী কাপরে পেচানো গয়না গুলো স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে বললো বাবার ঔষুধ আনতে ভুলোনাগো।।রহিম চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। গয়না গুলো ফিরিয়ে দিয়ে বললো না আমি এটা পারবো না এগুলো মা তোমাকে দিয়ে গেছে।আমি আজ স্কুলে যাব না।রহিম মিয়া পোশাক পরিবর্তন করে চলে গেলো তালুকদারের গেরেজে অটোরিকশার জন্য।আজ সে রিকসা চালক রহিম মিয়া।