নিশার পরন্ত বিকাল
=পাপিষ্ঠ আত্মা
গভীর বিকেল। রোদটা তখন একটু ম্লান হয়ে এসেছে। গায়ে হালকা বাতাস লাগছে, কিন্তু কোথাও যেন একটা অজানা অস্বস্তি ছড়িয়ে আছে। সবুজ পাটক্ষেতের ওপর সেই আলো পড়ে সোনালি হয়ে উঠেছে, চারপাশে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। চিরচেনা সেই নিস্তব্ধতা হঠাৎ ভেঙে গেল এক অশান্ত দৃশ্য দিয়ে।
মেয়েটি—নাম নিশা, বয়স বড়জোর পনেরো বা ষোলো—পাটক্ষেতের আল ধরে বেরিয়ে এলো। তার চুল এলোমেলো, জামায় মাটি, পাজামার নিচে লালচে রক্তের দাগ। চোখে জল নেই, কিন্তু তীব্র অভিমানে ভারী মুখ। যেন হৃদয়ের চিৎকার গিলে ফেলেছে নিজের মুখেই।
সে ধীরে ধীরে চরে চলে যাচ্ছে, যেন হাঁটছে—but directionless—চোখে ফাঁকা দৃষ্টি। কেউ তাকালে বোঝার উপায় নেই সে মানুষ না প্রেত।
তার শরীর বলে, কিছু হয়েছে। তার চুপচাপ থাকা বলে, সে কাউকে কিছু বলতে পারবে না।
তার পেছনে একটু ফাঁকে হেঁটে আসছে একজন পুরুষ—মধ্যবয়স্ক, পাকা চুল, গায়ে ঘামের ছাপ। তার বুক উঠছে-নামছে জোরে জোরে, সে হাঁপাচ্ছে, কিন্তু মুখে একটা তৃপ্তির হাসি।
তার চোখে নেই অনুশোচনা, নেই ভয়। মাঝে মাঝে সে নিচে হাত দিচ্ছে, নিজের ★টাকে চাপ দিচ্ছে—যেন সেই অভিজ্ঞতা আবার অনুভব করতে চাইছে।
তার দৃষ্টি সোজা—কিন্তু মেয়েটার দিকে নয়, ভবিষ্যতের দিকে, যেখানে সে বিশ্বাস করে—কেউ কিছু বলবে না।
---
সকালে নিশা বাড়ি থেকে বের হয়েছিল চাল-ডাল আনতে। মা বলেছিল,
“দেরি কইরো না, সন্ধ্যা হয়ে গেলে রাস্তায় চলাফেরা ঠিক না।”
নিশা বলেছিল, “আসি মা, তাড়াতাড়ি ফিরবো।”
হাটের পথে পাটক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল রফিক। গ্রামের একজন চেনা মুখ। বয়স প্রায় ৪৫। ছোটবেলায় সে নিশার বাবার সাথে কাজ করত। সবার চোখে সে “রফিক কাকা”।
নিশাকে দেখে ডাক দেয়, “এই নিশা, একটু আয় তো, তোমার আব্বার কথা বলতেছিলাম।”
নিশা কাছে যায়। সে কিছুটা ইতস্তত করছিল, তবু রফিকের পরিচিত মুখ তাকে একরকম নিরাপত্তা দিচ্ছিল। কে জানত—সেই মুখই হয়ে উঠবে ভয়াবহ।
---
রফিক ইশারা করে ভিতরে নিয়ে গেল। বলল, “একটা কথা ছিল, একবার দেখাও তো।” নিশা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার হাত ধরে টেনে নেয় পাটের ভেতরে।
“ছাড়েন কাকা! কী করছেন?” নিশা চিৎকার করতে চায়, কিন্তু চারপাশে কেউ নেই।
তার মুখ চেপে ধরে রফিক, ঠেলে ফেলে দেয় মাটিতে। নিশা কাঁপতে থাকে। সে বলে, “না কাকা, প্লিজ, ছেড়ে দিন!”
কিন্তু সে শোনে না। তার চোখে তখন এক অন্য রকম আগুন। সে ★ বের করে... নিশার পাজামা ছিঁড়ে ফেলে।
নিশা একবার চিৎকার করতে পারে, তারপর আর না। গলা অবরুদ্ধ হয়ে আসে। শরীর যেন অবশ হয়ে যায়। পাতার ফাঁকে সূর্যের আলো নিভে যায়।
মাটিতে তার কোমর ঘষে রক্ত বের হয়। নিশার চোখ তখনও খোলা—কিন্তু তার মধ্যে কোনো কিছু নেই, কেবল এক ঘোর।
---
সমাপ্তির পরে, রফিক উঠে দাঁড়ায়। নিশাকে দেখে না। নিজের শরীরে হাত বুলায়, ★টাকে আবার ছুঁয়ে দেখে, যেন সেই বিকৃত আনন্দের শেষটুকু অনুভব করতে চায়।
তার মুখে ঘামের মাঝে হাসি, চোখে আত্মবিশ্বাস—সে জানে, নিশা কিছু বলবে না। সমাজ কিছু বলবে না।
সে পেছনে তাকায় না। চলে যায় নিজের মতো।
---
নিশা উঠে দাঁড়ায়। গলা শুকিয়ে গেছে। কান্না আসছে না। পাজামায় লেগে আছে রক্ত, জামায় মাটির ছাপ, মুখে এক নিষ্প্রাণ ভাব।
সে এক পা এক পা করে আল ধরে হাঁটছে। মাথার মধ্যে তখন অসংখ্য প্রশ্ন—
“আমি কী দোষ করেছি?”
“মা জানলে কী বলবে?”
“আমি কাউকে বলতে পারবো তো?”
“বললে কি বিশ্বাস করবে?”
“আমি কি বেঁচে আছি এখনো?”
এক ছোট বাচ্চা ছেলে পাশ দিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল,
“আপু, তোমার জামায় লাল লাল কেন?”
নিশা তাকায় না। তার ঠোঁটে একটা চাপা হাসি, যা আসলে কান্না হয়ে গিলে গেছে। মনে মনে বলে,
“এই রক্ত শুধু শরীরের না… আত্মার রক্ত, আত্মসম্মানের রক্ত।”
---
রাতে সে বাড়ি ফিরে চুপ করে থাকে। মায়ের সামনে যায় না। এক কোণে বিছানায় শুয়ে পড়ে, পা গুটিয়ে। শরীর কাঁপে, ভেতরে এক অদ্ভুত ভয় জমে আছে।
রাতের অন্ধকারে সে কাঁদে—নিঃশব্দে। যেন কেউ শুনলে আবার বলবে—“তুই নিশ্চয়ই সম্মতি দিয়েছিস।”
সে জানে, এই সমাজ পুরুষের পক্ষ নেয়। মেয়েদের প্রশ্ন করে, বিশ্বাস করে না।
---
অন্যদিকে রফিক নিজের ঘরে ঘুমায়, শান্তিতে। তার স্ত্রী পাশে। সে আবার ★-তে হাত দেয়, চোখ বন্ধ করে স্মরণ করে বিকেলের সেই মুহূর্ত।
তার মুখে হাসি।
সে জানে—“এই সমাজে আমি পুরুষ, আমায় কিছু হবে না।”
---
সমাপ্তি?
না, এটা কোনো গল্পের শেষ নয়।
এটা কেবল শুরু—একটা অন্ধকার সমাজব্যবস্থার।
যেখানে নিশার মতো মেয়েরা প্রতিদিন মরে যায়, মুখে না বলে।
আর রফিকের মতো পুরুষেরা প্রতিদিন বাঁচে—মুখে না বলে, কিন্তু কাজে।
---
যদি নিশা মুখ খোলে একদিন? যদি সে বলে, “আমার শরীর আমার সম্মতি ছাড়া কেউ স্পর্শ করতে পারবে না”?
তবে হয়তো সেই পাটক্ষেত একদিন সাক্ষ্য দেবে—নীরবতা নয়, ন্যায়ের পক্ষে।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম ফারুকী
মোবাইল নং ০১৭১৩৮৭৮১৯২
প্রধান বার্তা সম্পাদকঃ মোঃ মাসুদ পারভেজ রুবেল
জিমেইলঃ notunkalom@gmail.com
ওয়েবসাইটঃwww.notunkalom.com
©️দৈনিক নতুন কলম দ্বারা সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত