কোন ভাবেই হিসাব মিলাতে পারছে না। বিজ্ঞানীরা ক্যালকুলেটর কম্পিউটার ইত্যাদি কত যন্ত্রই না আবিস্কার করেছেন শুধু হিসাবের জন্য। কিন্তু সে সব যন্ত্র ও আজ ব্যর্থ। ব্যর্থ না হয়ে উপায়ই বা কি। এটাতো আর টাকা পয়সা ধন দৌলত পাটী গণিত বা বীজ গণিতের হিসাব নয়। নির্দিষ্ট নম্বর চাপলো আর হিসাবটা মিলে গেলো। এটা জীবনের হিসাব। সংগ্রামী জীবনের হিসাব। একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের হিসাব। স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি হিসাব মিলানোর চেষ্টা করছে আজিম উদ্দিন। নির্জনে ভাবে, নিরবে হিসাব করে নিজের জীবনটাকে। কিন্তু পারে না সে তার হিসাব মিলাতে। ঘরে সদ্য বিবাহিত স্ত্রী বৃদ্ধ পিতা-মাতা, ভাই বোন। অন্যদিকে দেশের দুরাবস্থা, নির্যাতিত হচ্ছে দেশের মানুষ। ইজ্জত বিলিয়ে দিচ্ছে অসহায় মা বোনেরা। পড়েছে স্বাধীনতার ডাক। সেই ডাকে সাড়া দিচ্ছে ছাত্র, কৃষক, যুবক, বৃদ্ধ সবাই। ঘরে থাকতে পারলো না আজিম যা তুই তোর দেশকে মুক্ত করে নিয়ে আয়। আমি জানি তোদের মতো বীর ছেলেরাই এই দেশকে মুক্ত করতে পারবে। কিন্তু জানি না দেখে যাওয়ার ভাগ্য হবে কিনা? আজিম মায়ের কদম ছুঁয়ে বাবার কদমে পড়ে। সপ্তপ্ত হৃদয়ে বাবাকে বলে বাবা আমাকে বিদায় দাও। চেয়ে দেখো বাবা চারদিকে মা বোনদের হাহাকার আর শত্রুদের ধ্বংসলীলা। এখন তুমিই বলো বাবা। আমরা যদি ঘরে বসে থাকি। তাহলে এই দেশকে রক্ষা করবে কে? দাও বাবা আমাকে বিদায় দাও। অশ্রুসিক্ত নয়নে তার বাবা বলেছিলো যা বাবা তোকে বিদায় দিলাম। তারপর তার বাবার কি হয়েছিলো সে বলতে পারে না। পরে শুনেছে তার বাবা সেই দিনই পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। ভাই বোনদের কাছে বিদায় নিয়ে চলে আসে সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর নিকট। বেদনার্ত অন্তরে তার স্ত্রী মুক্তা বলে হে প্রিয় মাত্র সাত দিন হলো আমাদের বিয়ের বয়স। বিয়ের সাজ এখনো শরীর থেকে মুছে যায় নি। অথচ আজই বিচ্ছেদের মালা গলায় নিতে হচ্ছে। ভাবতেই গা শিহরে উঠে। জানি আজ তোমাকে বাধা দেওয়া আমার পক্ষে ঠিক হবে না। বাধা দিলেও তুমি মানবে না। আমি এটাও জানি তোমাকে খুশি মনে বিদায় দেওয়া উচিত। আরো জানি তুমি যাচ্ছ মহৎ কার্যসাধন করতে। আর এটাও সূর্যালোকের ন্যয় স্পষ্ট যে হয়তো তোমার জন্যই বেঁচে যেতে পারে একটি জাতি। মুক্ত হতে পারে দেশ। কিন্তু পারছি না তোমায় বিদায় দিতে। হৃদয় ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাচ্ছে। আমার বুকটা চিরে যদি তোমাকে দেখাতে পারতাম তবে বুঝতে আমার ব্যথা। আমি কি জানতাম আজই তোমাকে হারাতে হবে? না প্রিয় না। তোমাকে আমি বিদায় দিতে পারি না। বিদায় দিতে…. কথা শেষ করতে পারে না। আজিমকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। মুক্তার পিঠে হাত রেখে আজিম ধরা গলায় বললো মুক্তা। আমি তোমার দুঃখ বুঝি। আমি জানি আমাকে বিদায় দিতে তোমার অনেক কষ্ট হবে। আমি তোমার স্বামী। আমার নিকট তোমার অনেক চাওয়া। সে আমি পূরণ করতে পারি নি। তারপূর্বেই ডাক পড়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের। তুমি কান পেতে শুনো মা বোনদের আহাজারি শোনা যাচ্ছে। চেয়ে দেখ শত্রুরা দেশকে লুটে পুটে খাচ্ছে। এখন তুমিই বলো মুক্তা আমি কি ভাবে বসে থাকি? এযে আমার মাতৃভূমির ডাক। দেশকে মুক্ত করার ডাক। মা বোনদের ইজ্জত রক্ষা করার ডাক। তাদের ডাকে যদি আমরা সাড়া না দেই। তাহলে কে সাড়া দেবে বল? দেশের স্বার্থে ওই নির্যাতিত মা বোনদের স্বার্থে আমাকে বিদায় দাও। দেখ এটা তোমার আমার সবার…. কথা শেষ করতে পারেনা আজিম উদ্দিন। চোখ দুটি কেন যেন বিদ্রোহ করে উঠলো। কোন বাধাই মানছে না। প্রায় উচ্চ স্বরেই কেঁদে দিলো আজিম উদ্দিন। মুক্তা আজিমের বুকে মাথা রেখে বললো প্রিয় তোমাকে বিদায় দিতে আসলেই আমার ইচ্ছা করছে না। বুকটা ফেটে যাচ্ছে তোমাকে বিদায় দিতে। তবুও দেশের স্বার্থে ওই মা বোনদের করুণ আর্তনাদে সাড়া দিতে তোমাকে খুশি মনে বিদায় দিলাম। যাও দেশকে শত্রু মুক্ত করো। এটাই আমার সকল চাওয়া। আজিম উদ্দিন মুক্তাকে আরো একটু শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরে বললো মুক্তা তুমি শান্ত হও। তুমি শক্ত হও। দেশ মুক্ত হবে। তোমার আজিম তোমার বুকেই ফিরে আসবে। আর যদি না আসে তবে তাকে ক্ষমা করে দিও। বলে আজিম চলে গিয়েছিলো যুদ্ধে। যাওয়ার দু’দিন পর তার বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়েও সে ছিলো অটল। তাকে যুদ্ধে পাঠানোর অপরাধে তার মাকেও হত্যা করা হয়েছে। ছোট বোনও ভাই দু’জনই নিখোঁজ। স্ত্রীর বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে বেড়ানোর সংবাদে সে ভেঙ্গে পড়েছিলো ঠিকই। কিন্তু মনোবল হারাল না। শত্রু বাহিনীর গ্রেনেডে ডান হাত উড়ে যায় আজিম উদ্দিনের। তবুও পিছু হটেনি আজিম উদ্দিন। বাম হাত দিয়েই পাল্টা জবাব দিয়েছেন তিনি। একদিন দেশ স্বাধীন হলো। বিজয়ের পতাকা পত পত শব্দে উড়লো বাংলার মাটিতে। সবাই পেল একটা স্বাধীন দেশ। ফিরে পেল সব কিছু। মুক্তাও স্বাধীন দেশ পেল। মুক্ত বাতাস পেল। শুধুপেলনা প্রাণ প্রিয় স্বামীকে। যার সাথে বিয়ের সাত দিন পরই বিচ্ছেদ ঘটেছিল। সে জানে না তার স্বামী আদৌ বেঁচে আছে কি না? তার পিতা মাতা শ্বশুর শ্বাশুড়ী সবাইতো মারা পড়লো ওই পাক বাহিনীর হাতে। তাহলে কি তার স্বামী ও মারা পড়েছে ওই পাক বাহিনীর হাতে? হঠাৎ একদিন আজিম ফিরে আসে। মুক্তা ফিরে পায় তার স্বামীকে। আজিম ফিরে পায় জীবন। তার সবচেয়ে বড় পাওয়া এ বিজয় স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যটাকে সে ছিনিয়ে আনতে পেরেছে। ভাই বোন দু’জন আজও নিখোঁজ। তবুও সে সুখী দেশকে মুক্ত করতে পেরেছে কিন্তু সেকি জানতো? এ স্বাধীনতাকে ঘিরে দেশে চলবে অরাজকতা। সেকি জানতো একেই পুঁজি করে দেশে চলবে দল বাজির খেলা? সেকি জানতো দেশ এখনো পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ? সেকি জানতো এ স্বাধীনতাকে পুঁজি করে দেশকে লুটে পুটে খাবে? না সে শুধু জানতো দেশ থেকে শত্রুরা বিতাড়িত হবে। দেশ হবে স্বাধীন। শান্তি ফিরে আসবে বাংলার ঘরে ঘরে। সবার মুখে থাকবে হাসির ঝিলিক। আর এর বিনিময়ে নিজেকে হতে হবে যুদ্ধাপরাধী। হতে হবে রাজাকার। আর বাড়ি জ্বালানো হবে। এসব তথ্য কি আজিম উদ্দিনের নিকট ছিলো? হয়তো ছিলোনা তবে নিশ্চয়ই সে জানতো দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হবে। আর এতে কিছু লোক প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে বিরোধীতা করবে। তারাই একদিন নিজেদেরকে বড় এবং দেশবন্ধু ভাববে। সে যুদ্ধ করেছে দেশকে মুক্ত করার জন্য। সে যে মুক্তি যোদ্ধা নাম ধারণের জন্য যুদ্ধ করে নি। তাই বলে তো তিনি চাননি একজন দেশদ্রোহী লোক মুক্তিযোদ্ধা উপাধীতে ভূষিত হোক। আর নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হয়েও যুদ্ধাপরাধী বা রাজাকার উপাধী অর্জন করে ঘরে বসে তামাক টানতে হবে। স্বাধীনতার ৩৮ বছরেও আমরা ভাঙ্গতে পারিনি পরাধীনতার লৌহ শিকল। সময়ের পরিবর্তনের অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু পরিবর্তন হয়নি আজিম উদ্দিনের জীবনের। যা হয়েছে সকলই অপমান লাঞ্চনা বঞ্চনায় পরিণত হয়েছে। নিজে মুক্তিযোদ্ধা হয়েও ছেলেকে জীবন দিতে হয়েছে নাকি রাজাকারের সন্তান হিসাবে। এটাই কি তার জীবনের শেষ হিসাব? একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তার জীবনের শেষ হিসাব কি হবে? এর জবাবের প্রত্যাশায় আজিম আজ নিরব নিবৃতে ভাবে।
Previous Articleস্বামী হত্যার বিচার চেয়ে কয়রায় স্ত্রীর আকুল মিনতি: দীর্ঘ অপেক্ষার পরর অধরাই রয়ে গেলো ন্যায় বিচার
Next Article রৌমারীতে বেড়া দিতে গিয়ে বৈদ্যুতিক শকে একজনের মৃত্যু
Related Posts
© ২০২৫ | নতুন কলম।
সম্পাদক এবং প্রকাশকঃ মোহাম্মাদ মাহবুবুল আলম ফারুকী।
মোবাইল নম্বরঃ ০১৯৫৩৮১১৮৭৭
ইমেইলঃ notunkalom@gmail.com,
প্রধান উপদেষ্টাঃ প্রভাষক এম আর ফেরদৌস।