মাওলানা মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম ফারুকী
বাংলাদেশের রাজনীতিতে হইচই, বিতর্ক, টকশো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার ও প্রতিপক্ষকে আক্রমণের যে প্রবণতা আমরা প্রতিনিয়ত দেখি, তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক অদ্ভুত নিঃশব্দতা—যার নাম জামায়াতে ইসলামি। সবাই যখন চিৎকার করে, বক্তব্য দেয়, ফেসবুক পোস্টে ঝড় তোলে, তখন একটি দল নিশ্চুপ থেকে কাজ করে যায়। এই নীরবতাই তাদের সবচেয়ে বড় কৌশল, আর এই কৌশলই ক্রমে পরিণত হচ্ছে ভয়-জাগানো এক রাজনৈতিক বাস্তবতায়।
পঞ্চাশ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে বহুবার মনে হয়েছে জামায়াতের গল্প বুঝি শেষ। বিশেষ করে ৫ আগস্টের নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের পর অনেকেই ভেবেছিল, এই দল ইতিহাসের পাতায় জায়গা নিয়েছে, ধুলো জমেছে তাদের নামের ওপরে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে—তারা হারায়নি, তারা হারিয়ে যায়নি। বরং সময়ের সঙ্গে নিজেদের নতুনভাবে গুছিয়ে নিচ্ছে, কৌশলে।
জামায়াত কখনও বলে না—তারা কী করছে, বা কেন করছে। তারা মাঠে নামে, খেলে যায়—নীরবে। এই ‘চুপচাপ’ উপস্থিতি যেন অনেক বেশি শক্তিশালী, অনেক বেশি পরিকল্পিত। তারা এমনভাবে চলে, যেন ডান হাত যা করছে, বাম হাতও জানে না। ঠিক এই জায়গাটিতেই তারা আলাদা, এবং অনন্য।
নির্বাচনী প্রেক্ষাপটে আজ যখন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলেন, বিএনপির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হবে জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর ভাঙন কিংবা নতুন গঠিত এনসিপি, তখন তারা ভুলে যান এক নীরব শক্তিকে—জামায়াত। তারা ভুলে যান, এই দল দীর্ঘ সময় পরেও সংগঠনের মূল কাঠামো ধরে রাখতে পেরেছে। তারা ভুলে যান, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আজও এই দলের ঘাঁটি শক্ত, সমর্থক মজবুত এবং সাংগঠনিক কাঠামো কার্যকর।
জামায়াত কথা বলে না। তারা প্রতিপক্ষকে হেয় করার প্রতিযোগিতায় নামে না। তারা রাজনৈতিক উচ্চবাচ্য কম করে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে গড়ে তোলে এমন এক পরিকল্পনা, যেটা চোখে পড়ে তখন, যখন ফলাফল দৃশ্যমান হয়। তারা নিজেকে কেন্দ্রবিন্দুতে আনার জন্য সোচ্চার হয় না, কিন্তু সময় এলেই বোঝায়—তারা এখনও ‘কি প্লেয়ার’।
এই প্রবন্ধের সারাংশ হলো—জামায়াত হারিয়ে যায়নি, বরং কৌশলে নিজেকে গুছিয়েছে। তারা রাজনীতির সেই ‘আনসিন ফোর্স’ যারা সামনে না থেকেও প্রভাব ফেলতে পারে। তাদের নীরবতাই সবচেয়ে বড় বার্তা। আর এই নীরবতাই ভবিষ্যতের জন্য এক বড় রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি করে দিচ্ছে।
একদিন সবাই বলবে—”তারা কোথা থেকে এল?”
কিন্তু যারা মন দিয়ে দেখছিল, তারা জানে—তারা ছিলই।
শুধু চুপচাপ ছিল।